Tuesday 7 July 2015

ছোটগল্প - কবি -স্পর্শের বাইরে ~


**কবি**
    -স্পর্শের বাইরে



(লেখাটি উত্সর্গ করলাম সেই সব কবি'দের,যাদের কবিতা কখনও মলাটবন্দি হয়নি,,হয়ত কখনও হবে না)

"আপনি এখনও বসে আছেন?"
ভদ্রলোক যঠেষ্ট বিরক্ত বোধ করলেন,এবং তা লুকানোর চেষ্টা করলেন। অনুভূতি লুকানো যায়না। বিরক্তি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় ভদ্রলোকের মুখ দেখাচ্ছে ছুঁচোর মত। আমি হাসিহাসি মুখে ভদ্রলোকের সামনে কি দাড়ালাম,তারপর হাত জোড় করে বললাম
"ভালো আছেন বিনোদন বাবু? শরীর কেমন?"
ভদ্রলোক এবার আক্ষরিক অর্থেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন এবং আবার আগের মতন তা লুকানোর চেষ্টা করে বললেন-
"স্পর্শবাবু,শুনুন একটা কথা বলি। আগে আপনি বসুন,..বসুন,তারপর বলছি।"
আমি বসলাম।
"আপনি একজন কবি মানুষ। কবিদের প্রত্যেকটি ভাষা-শব্দ হবে নিখুঁত। তাই না? নয়ত সাধারণ মানুষের শব্দচয়ন আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য কি থাকল? কাল থেকে যেকোন হকারও কবিতা বলে জিনিস বিক্রি করতে শুরু করবে। তাই না?"
-" সে তো অবশ্যই।"
- "তাই আপনাকে আবারও বলছি,আমার নাম বিনোদন নয়,,বিনয়ন। বিনয়ন সামন্ত। বুঝতে পেরেছেন??"
- "হ্যাঁ। বড় ভালো নাম।"
-" ধন্যবাদ। এবার বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?? যদি আবার সেই পুরনো অনুরোধ থাকে,তবে আমাকে মাফ করবেন।"
-" আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি সেই পুরনো অনুরোধই আপনার কাছে আবার করতে এসেছি। যদি আমার কবিতাগুচ্ছ মলাটবদ্ধ করেন।"
-" সম্ভব নয় স্পর্শবাবু"।
-"কেন সম্ভব নয়? আমার কবিতাগুলি কি আপনার পছন্দ নয়? সত্যিকারের বলুন তো!"
-"অবশ্যই পছন্দ"
-"তবে?"
-"অনেক ব্যাপার থাকে স্পর্শবাবু। আপনি তা বুঝবেন না। আর আমি আপনাকে তা বোঝাতেও চাই না। সেটাই আপনার এবং আমার জন্য মঙ্গল।"
-"সামন্তবাবু,আপনি নিজেও জানেন আমি একজন সম্ভাবনাময় কবি। শুধু একটা স্কোপ চাই।"
-" জানি ভাই। আপনি অবশ্যই একজন সম্ভাবনাময় কবি। কিন্তু দু:খের বিষয় আমি আপনাকে স্কোপ দিতে পারব না। পশ্চিমবঙ্গের রাস্তাঘাটে এরকম হাজারো সম্ভাবনাময় কবিদের খুঁজে পাবেন। ওত কষ্ট করতে হবে না। বিভিন্ন সোশাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতেই যান না,লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীতের স্টাটাস ঘেঁটে দেখুন,লক্ষ লক্ষ কবিতা খুঁজে পাবেন। তাদের সবাইকে স্কোপ দিতে গেলে আমরা আর ব্যবসা চালাতে পারব না। আসলে তো ব্যবসাই করি তাই না! আমাদেরও বউ-ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে হয়।"
-" সামন্তবাবু আপনি জানেন যে আমার পাঠক আছে,যারা আমার কবিতা পড়ে। আপনারা দু-একটা চিঠিও পেয়েছেন। আপনাদের বিভিন্ন পুজো সংখ্যাগুলোর একটা-দুটোতে আমার কবিতা বের হয়। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ঘাটলেও আমার কবিতা পাবেন।"
-" আরে ধুর! আপনি এটাকে উনবিংশ শতাব্দি ভেবেছেন নাকি? লিটল ম্যাগাজিন এখন লক্ষ লক্ষ পাবেন। সেগুলোর আর পাঠক তৈরির ক্ষমতা নেই। সরি,একটু ভুল বললাম,,কবিতার পাঠক তৈরির ক্ষমতা নেই। এখন সবাই উপন্যাস খোঁজে ভাই। কোন বার্ষিকীতে কোন লেখক,কোন উপন্যাস লেখেছেন এখনকার পাঠক তা বলে দেবে। পূজাবার্ষিকীগুলো বিক্রিই হয় উপন্যাসের জন্যে। কবিতা পড়তে কজন পাঠক পত্রিকা কেনে???? 
এক কাজ করুন স্পর্শবাবু। একটা উপন্যাস লিখে ফেলুন। ছাপাবার চেষ্টা করব। উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে আপনাকে অনেক মানুষ চিনবে। তারপর কবিতা-তবিটা যা লেখার লিখবেন।"
-"সামন্তবাবু,আমি একজন কবি। আমার সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটবে উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে? এটা ভাবতেও পারি না!! তার থেকে একটা কাজ করুন না। আপনাদের পত্রিকা তো পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে নামকরা পত্রিকা। ওখানে আমার কিছু কবিতা নিয়ে একটা ক্রোড়পত্র বার করুন না। সাধারন মানুষের (পাঠকের) আমাকে চেনার এর থেকে ভালো উপায় আর কি থাকতে পারে!"
ভদ্রলোক এবার উচ্চস্বরে হাসলেন।
সাধারণত এধরনের হাসি মধ্যেরাতে হায়েনা'দের গলা থেকে শুনতে পাওয়া যায়। কি আশ্চর্য! !! ভদ্রলোককে এখন দেখাচ্ছেও হায়েনার মত। কিচ্ছুক্ষণ আগে ছুঁচোর মত লাগছিল না!
-"স্পর্শবাবু,এর মানে আপনি বলতে চাইছেন আমি আমাদের বৃহত্তম পত্রিকায় দেড়-পেজ জুড়ে আপনার কবিতার ক্রোড়পত্র বের করব... তাই তো?"
-"হুম্"
-"দেড় পেজ এর দাম আপনি জানেন?? ওই জায়গায় দুটো বিজ্ঞাপন দিলেই ৮ লাখ উঠে আসবে। আপনি কখনও দেখেছেন আমাদের পত্রিকায় দির্ঘপেজ জুড়ে আমরা কোনো অনামি লেখকের ক্রোড়পত্র বার করেছি?? "
- "আপনি আমার ক্রোড়পত্র ছাপাবার পরেই আমার কবিতা নিয়ে একটা বই বার করে ফেলুন না। রয়ালিটি লাগবে না। তাতেই টাকা উঠে আসবে।"
ভদ্রলোক আবারও হাসতে শুরু করলেন।
এবার আমি বিরক্ত লুকানোর চেষ্টা করলাম। কি এমন কথা বললাম যাতে এত হাসি পায়! আচ্ছা আমার মুখ কি এখন ছুঁচোর মত দেখাচ্ছে?
-" স্পর্শবাবু,আপনার ধারনা নেই আপনি কি বলেছেন। শুনুন,আমরা একটা উপন্যাস পূজাবার্ষিকীতে বের করি। সেই উপন্যাসএর টানে পাঠকরা পত্রিকা কেনে। তারপর আবার সেই উপন্যাসটাই মলাটে বন্দি করে দু-তিনশ টাকায় বাজারে ছাড়ি। আবারও তা বিক্রি হয়ে যায়। কেউ পত্রিকায় না পড়ার কারনে কেনে,,কেউ সংগ্রহে রাখার জন্যে কেনে। কবিতায় লাভ নাই ভাই। পূজাবার্ষিকীগুলোতে একটা-দুটোর বেশি কবিতা দেওয়া যায় না। আর একটা-দুটো কবিতা দুশো টাকায় বিক্রি হয় না স্পর্শবাবু। তাও ধরুন আমি আপনার একটা বই বাজারে বের করলাম। আপনি খুব ভালো লেখেন আমি জানি। হয়ত কিছু পাঠক কিনলো। তাদের ভালো লাগল। দু-একজন পাঠক আপনার নাম জানলো। নাম জানার সাথে সাথেই দেখবেন দু-একদিনের মধ্যে আপনার বই এর একটা পিডিএফ(PDF) ভার্সন বেড়িয়ে গেছে। টাকা খরচ করে কে কবিতার বই কিনতে যাবে? একশোর মধ্যে কিনবে একজন। হাজারে দশজন। তাদের ওই বই কেনায় আমার তো পেট চলবে না। আপনি ফেমাস হলেও আমার পেট চলবে না। আপনার নাম ছড়াবে পিডিএফ (PDF) এর মাধ্যমে। আপনি ফেমাস হবেন। আমরা প্রকাশকরা ডুবব। একটা উপন্যাস লোকে ধৈর্য ধরে ইবুকে পড়বে না। সবাই তা পড়তেও পারে না। কিনে নেবে। কিন্তু একটা কবিতা পিডিএফ এ পড়তে কোনো বাঁধা নেই। বুঁঝছেন???"
-"এই ইবুক-পিডিএফ এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে আমরা কি এক আছাড় মেরে রাস্তায় এনে ফেলছি না সামন্তবাবু?"
-"সেটা আমাকে বলছেন কেন? পাঠকদের বলুন। এজন্যই প্রতিবছর ডজনে-ডজনে লেখক জন্মাচ্ছে। কবি কটা জন্মায়? এক কাজ করুর স্পর্শবাবু,,পিডিএফ নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন। সামনের সংখ্যায় ছাপার চেষ্টা করব। হা হা হা।
স্পর্শবাবু এখনতো উঠতে হয়..একটু কাজ আছে। আপনি চা খাবেন??"
-"না"
-"খান এক কাপ। দিতে বলি?"
-"না থাক।"
প্রকাশনা থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসলাম।
আজ আকাশ মেঘলা,বৃষ্টি হব হব করেও হচ্ছে না। আমি এখন পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছি। প্রত্যেক রোববার এটাই আমার একমাত্র রুটিন। বিভিন্ন প্রকাশনায় হাঁটাহাঁটি করা। প্রায় পাচঁ বছর ধরে করে আসছি। আগে সপ্তাহে তিন-চারদিন এই রুটিন ছিল,একটা সরকারি চাকরি পাবার পর রোববার ছাড়া আর সময় হয় না।
রোববার দিনটায় সারাদিন আমি কিছু খাই না। খালি পেটে নাকি খুব ভালো কবিতা আসে। বহুবছর আগে 'একজন' একথা বলত। এখনো চোখের সামনে ভাসে সেই দিনগুলি। আমি পড়ার টেবিলে একমনে বসে কবিতা লিখতাম। 'ও' জানালা দিয়ে এসে বিরক্ত করত।
-"এই যে কবিসাব, কি করছেন?"
-"তিথি এখন লিখছি,বিরক্ত কর না।"
-"কি লিখছেন একটু বলুন তো। নতুন কি কবিতা,কবিতার নাম কি?"
- "নাম বললে তুমি বুঝবে?"
-"কবিতাই বুঝিনা,আর নাম! হা হা হা...."
বলেই 'ও' চুরি নাড়িয়ে হাসত। চুরির সেই রিনঝিন রিনঝিন শব্দে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠত।
-"কবিতার নাম হল 'তিথি'। "
'ও' লজ্জা মাখা গলায় বলত..
"ইস! অন্য কোনো নাম পেলেন না? আপনি খুব অসভ্য"।
-"অসভ্যের কি দেখলে,আমার পরের কবিতার নামও ঠিক করা হয়ে গেছে। কি নাম জান?"
-"কি??"
-"আদর।"
-"ইসসস দুষ্টু... আপনার সাথে আর কথা নেই।"
-"আপনি আপনি করছো কেন??"
-" নয়ত আর কি বলব? ওত বড় দাড়ি রেখেছেন। আপনাকে দেখাচ্ছে সাধুপুরুষের মত।"
-"কবিরা এরকম দাড়িই রাখে। রবি ঠাকুরের দাড়ি দেখনি?"
-"উনি কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে দাড়ি রাখতেন। তরুন বয়সে ওনার খুব সুন্দর গোঁফ ছিল। তোমার তো মনে হয় গোঁফই ওঠে নি। হাহাহা...."
বলতে বলতেই ওর চুরি আবার বেজে উঠত। মন স্পর্শ করে যেত সে শব্দ।...
পার্কে বসে মেঘলাদিনে এসব ভাবছি। ঘোর কাঁটল এক বাদামওয়ালার ডাকে-
'বাবু,বাদাম লিবেন?'
-"টাকা নেই ভাই। আজকের দিনে আমি টাকা নিয়ে বেড়াই না। আমাকে বিভিন্ন প্রকাশনায় ভিক্ষা করে বেড়াতে হয়। তবে তুমি যদি একঠোঙা বাদাম দাও,মূল্যবান একটা জিনিস পাবে।"
-"কি?"
-"কবিতা। আমার লেখা নতুন একটা কবিতা"।
বাদামওয়ালা আমাকে অবাক করে একঠোঙা বাদাম দিয়ে বলল
-'কন। একখান কবিতা কন। শুনি।'
আমি বলতে শুরু করলাম....
"খুব সম্ভবতঃ একজন প্রেমিক ছিল সে, 
কাগজের ভাঁজে গোপনে জমাতো জোছনার জল, তারার সুর, ক্ষয়ে পড়া পালকের মত দীর্ঘশ্বাস কিছু।..
নৃশংস ছাই হয়ে ঝরে যেতে যেতে একদিন জেনে গেলো-
এই শহরে নির্ঘুম সোডিয়াম লাইটেরা নিশ্চুপ থেকে সারারাত শুধু প্রায়শ্চিত্তের কথা ভাবে।
মাছরাঙার নীল ডানায় প্রতীক্ষায় না থেকে একদিন-
বহুবার করে বাঁচার সাধ হল তাঁর-কবিতার।
ধ্বংসস্তূপের মাঝে নতুন পৃষ্টা, ছাই ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ঝলমলে বাজ ফিনিক্স। 
মাছির চোখের দ্যুতি নিয়ে পৃথিবীকে দেখছিল, নতুনভাবে, হাজার রাত্রির রূপকথা- যেন গুঁড়িয়ে যাওয়া শত টুকরো আয়নার ভেতর শত শত কবিতা'কে।
যা কোনোদিন কোনো মলাটে ঠাই পাবে না।........."
হঠাৎ কবিতা থামিয়ে আমি বাদামওয়ালাকে ত্বারস্বরে জিজ্ঞেস করলাম
-"চুরির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?? রিনঝিন রিনঝিন চুড়ির আওয়াজ??"
তিনি গভীর বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।।

Monday 6 July 2015

ছোটগল্প ~ ঋজু পাল

শেষ থেকে শুরু 
ঋজু পাল :~

    সকালে বাড়ি ফিরলাম , শরীর টা বড্ড দুর্বল এখনো । তিন দিন হসপিটাল এর বিছানাতে কাটানোর পর আজ নিজের চেনা পরিবেশে ফিরতে খুব ভালো লাগছে । বাড়ির পরিবেশ এখনো থমথমে । বউদি পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে । বাবা সেই যে ট্যাক্সি থেকে আমায় নামিয়ে ঘরে নিয়ে এল , তারপর থেকে আর দেখতে পাচ্ছি না । মা বোধহয় ঠাকুর ঘরে , যমের মুখ থেকে ছেলে ফিরে এসেছে ,ঠাকুরের প্রাপ্য ধন্যবাদ টুকু দিতে গেছে ! আর আমি? খোলা জানলা দিয়ে চারপাশের আলো ঝলমলে আকাশ তাকে দেখছি, সত্যি ই কি কোন দরকার ছিল ওরকম একটা পদক্ষেপ নেওয়ার ? জানি না। 
হটাত আমার সাত বছরের পুচকু ভাইপো এসে বলে ফেলল ; কাকু তুমি আর যাবে না তো আমায় ছেড়ে ? তাহলে আমায় ঘুরতে কে নিয়ে যাবে ? বাবা র মত তুমিও স্টার হয়ে.........।
ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম , না সোনা ,কোথাও যাবো না আমি । প্রমিস করলাম।
নাহ , এত ভালবাসা কে অগ্রাহ্য করার মত দুঃসাহস আমার নেই । নতুন জীবন শুরু করতে আমায় হবেই , পুরনো ডায়েরি গুলো কি করবো , ফেলে দেব ? স্মৃতি আঁকড়ে বসে থেকে কোন লাভ নেই ।
এই তো সেদিনের কথা , TCS এর ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট চলছে । দুটো ধাপ টপকে দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি শেষ ধাপের জন্য। মনে হচ্ছে পারবো না ,হবে না। মোবাইল টা বন্ধ করতে গিয়ে একটা মেসেজ চোখে পড়ল , All the best dear ! u have 2 do it smile emoticon 
মুহূর্তেই হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম । তারপর ? ...............
----হ্যালো , রাহুল দা , selected !!!!!!!!!! 
---জানতাম এটাই হবে । Heartiest congratulations !!!! যা বাড়ি যা , রাতে ফোন করছি ।
এই হল রাহুল দা , আনন্দে টগবগ করলেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না । দেখতে দেখতে দুবছর হয়ে গেল ,we r in a relationship ! আমাদের আলাপ Rainbow Pride Fest walk এ ।নিছক বন্ধুত্ব , তারপর একটু একটু ভাল লাগা , অতঃপর ভালবাসা । আজ চেন্নাই তে থাকলেও প্রতিদিন যোগাযোগ রাখা , কথা বলা কোনটাতেই খামতি নেই ।
মা খুব রাগারাগি করেছিল, বউদি ও , কলকাতা ছেড়ে চেন্নাই কেন যাচ্ছি । মা কে কোনমতে বুঝিয়েছিলাম , চাপ এর কি আছে , রাহুল দা আছে তো , এক অফিস , এক এপার্টমেন্ট , কোন অসুবিধা হবে না।
বাড়িতে সবাই জানে ,রাহুল দা আমার খুব প্রিয় বন্ধু , কিন্তু ওই টুকুই । তার বেশি কিছু বলার মত সৎসাহস আমার ছিল না ।
তারপর আর কি , চেন্নাই তে পা দেওয়া , একে নতুন জীবন , তারপর নিজের ভালবাসার মানুষের সঙ্গে একসাথে থাকতে পারার আনন্দ যে কতটা হতে পারে , সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এক সাথে অফিস যাওয়া, ফেরার সময় ঘুরে ফিরে ফ্ল্যাটে আসা , রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা , আর অনেক টা ভালবাসা !
সব তো ঠিকই চলছিলো , তবু কেন এমন হল ... রাহুল দা র বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য জোর করা , অপ্রত্যাশিত ভাবে ওর রাজি হওয়া, নিজের একটা আলাদা এপার্টমেন্ট খুঁজে নিতে অনুরোধ করা , আমার কান্নায় ভেঙে পরা ..................সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল !
কটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম ঠিক মনে নেই , তবে এটুকু খেয়াল আছে বাড়ির আর অফিস এর অনেককেই হসপিটাল এ দেখতে পেলেও , একজন কে পাই নি । আমার অভস্ত্য চোখ শুধু খুঁজে বেরিয়েছে তাকে , একসময় ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে ।
বাবু , তোর একটা চিঠি এসেছে , এদিকে আসতে পারবি ? বউদি র গলা শুনে চমকে উঠলাম । নিজের অজান্তেই কখন অতীতে ফিরে গেছিলাম।
সই করে চিঠি টা নিয়ে দেখি , Tech Mahindra র অফার লেটার ! কবে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম আর আজ এল ,পোস্টিং কোলকাতা তেই ।
কার চিঠি রে ? মা এগিয়ে এল ।
মা , আমি TCS ছেড়ে ভুল করি নি , আমি রাস্তা খুঁজে পেয়েছি । এবার নতুন করে সব শুরু করব ,শুধু তোমাদের জন্য !
হার সৌরভ কোনদিন মানে নি , মানবেও না।

Wednesday 1 July 2015

পুস্তক পর্যালোচনা ~প্রবুদ্ধ দাস

প্রবুদ্ধ দাসের পুস্তক পর্যালোচনা ~

বই : ঘুরি বেড়াই ছবি আঁকি
অঙ্কন ~ কথন : দেবাশীষ দেব
প্রকাশক : ঋতি প্রকাশন 
দাম : ৩০০ টাকা


যখন এক ভ্রমণপিপাসু মানুষ তাঁর নিজ ভ্রমণের আখ্যান শব্দের বদলে তুলির টানে বোঝান সেই অভিনব প্রয়াসের ফলস্বরূপ এই বই। শিল্পী দেবাশীষ ছোটবেলা থেকেই ঘুরতে ভালোবাসেন । এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই কলমের বদলে তুলি হয়ে ওঠে তাঁর সঙ্গী। যে দৃশ্য তাঁর মন কাড়ে সেই দৃশ্যই রঙ আর তুলির টানে জীবন্ত হয়ে ওঠে আর আমার মতো ভ্রমণপিপাসু মানুষদের এক নস্টালজিয়াতে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। অঙ্কন শিল্প চিরকালই আমায় টানে যদিও নিজে আঁকতে তেমন পারিনা কিন্তু অনেক সময়ই আর্ট গ্যালারি হয়ে ওঠে আমার বন্ধু বইয়ের পাশে।
এই বই যারা বই ভালোবাসেন ,যারা ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোবাসেন এবং যারা আঁকেন তাঁরা নিশ্চয় সংগ্রহ করুন । ঠকবেন না ।


পুস্তক পর্যালোচনা ~ নিবেদিতা রায় চৌধুরী


নিবেদিতা রায় চৌধুরীর পুস্তক পর্যালোচনা ~

নামঃ উজান-যাত্রা
লেখিকাঃ বাণী বসু
প্রকাশকঃ আনন্দ প্রকাশনী
মূল্যঃ ১৫০/-

নামকরণ দ্বারাই এই বইটির মূল বিষয় ঘোষিত হয়েছে। লেখিকা তাঁর বহুল সমাদৃত লেখনীর মাধ্যমে এক শিকড়ে ফিরে যাওয়ার যাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। গুজরাটি কটন কিং নরেন্দ্রজীর একমাত্র কন্যা কস্তুরীর জন্য সেই যাত্রা তাঁর মাকে খোঁজার, আবার উচ্চশিক্ষিত আদিবাসী যুবক কাজলের জন্য সেই যাত্রা তার আদি দেশকে নতুন করে আবিষ্কার করার। আর এই যাত্রাপথে তারা সঙ্গী হিসাবে পেয়েছে অসামান্যা রূপসী আর্যকন্যা শিখরিণী এবং সাধারণ বাঙালী মেয়ে মিলিকে। এই যাত্রা শুধু স্থান থেকে স্থানান্তরে নয়, ধারণা থেকে জ্ঞান ও জানা থেকে আবিষ্কারেও বটে। আমরা এই সমগ্র যাত্রাপথের বর্ণনা বিভিন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে পেয়েছি। কিন্তু লেখিকার সব থেকে বড়ো কৃতিত্ব আমাদের সঙ্গে একটি বিশেষ প্রজন্মের পরিচয় করানো, যাঁদের সম্পর্কে বর্তমান ভার্চুয়াল প্রজন্ম সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাঁরা একদিন অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে এমন একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা গান্ধীজীর আদর্শ রামরাজ্য হবে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জটিলতা এবং তথাকথিত নেতৃবৃন্দের স্বার্থসিদ্ধির কূট প্রবণতা দেখে তাঁরা অপরিসীম হতাশার সম্মুখীন হন। তাঁরা কেউ নিবেদিতার মতো একাকীত্বের জীবন বেছে নেন, কেউ রমার মত শিশুদের নিয়ে সময় কাটান, আবার কেউ কল্যাণীর মতো সত্যিকারের মানুষ গড়ার প্রচেষ্টার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এই মানুষদের মধ্যে কিছুজনের নাম আমরা ইতিহাস বইতে অথবা সাধারণ জ্ঞানের বইতে "ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী" অধ্যায়ে পড়ি। কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন এবং স্বাধীনোত্তর ভারতে তাঁদের disillusionment-এর কাহিনী লেখিকা সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তবে সমাপ্তিটা যেন একটু দ্রুতই এসেছে, যেখানে আরো বিস্তারের সুযোগ ছিল।
এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় এই বইটি। পরতে পরতে জড়িয়ে আছে উত্তেজনা এবং গতি। আপনারা পড়ুন, পড়ে জানান আপনাদের মত। প্রত্যেকের শিকড়ে ফেরার যাত্রার বীজ লুকিয়ে আছে এই কাহিনীতে।