Tuesday 7 July 2015

ছোটগল্প - কবি -স্পর্শের বাইরে ~


**কবি**
    -স্পর্শের বাইরে



(লেখাটি উত্সর্গ করলাম সেই সব কবি'দের,যাদের কবিতা কখনও মলাটবন্দি হয়নি,,হয়ত কখনও হবে না)

"আপনি এখনও বসে আছেন?"
ভদ্রলোক যঠেষ্ট বিরক্ত বোধ করলেন,এবং তা লুকানোর চেষ্টা করলেন। অনুভূতি লুকানো যায়না। বিরক্তি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় ভদ্রলোকের মুখ দেখাচ্ছে ছুঁচোর মত। আমি হাসিহাসি মুখে ভদ্রলোকের সামনে কি দাড়ালাম,তারপর হাত জোড় করে বললাম
"ভালো আছেন বিনোদন বাবু? শরীর কেমন?"
ভদ্রলোক এবার আক্ষরিক অর্থেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন এবং আবার আগের মতন তা লুকানোর চেষ্টা করে বললেন-
"স্পর্শবাবু,শুনুন একটা কথা বলি। আগে আপনি বসুন,..বসুন,তারপর বলছি।"
আমি বসলাম।
"আপনি একজন কবি মানুষ। কবিদের প্রত্যেকটি ভাষা-শব্দ হবে নিখুঁত। তাই না? নয়ত সাধারণ মানুষের শব্দচয়ন আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য কি থাকল? কাল থেকে যেকোন হকারও কবিতা বলে জিনিস বিক্রি করতে শুরু করবে। তাই না?"
-" সে তো অবশ্যই।"
- "তাই আপনাকে আবারও বলছি,আমার নাম বিনোদন নয়,,বিনয়ন। বিনয়ন সামন্ত। বুঝতে পেরেছেন??"
- "হ্যাঁ। বড় ভালো নাম।"
-" ধন্যবাদ। এবার বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?? যদি আবার সেই পুরনো অনুরোধ থাকে,তবে আমাকে মাফ করবেন।"
-" আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি সেই পুরনো অনুরোধই আপনার কাছে আবার করতে এসেছি। যদি আমার কবিতাগুচ্ছ মলাটবদ্ধ করেন।"
-" সম্ভব নয় স্পর্শবাবু"।
-"কেন সম্ভব নয়? আমার কবিতাগুলি কি আপনার পছন্দ নয়? সত্যিকারের বলুন তো!"
-"অবশ্যই পছন্দ"
-"তবে?"
-"অনেক ব্যাপার থাকে স্পর্শবাবু। আপনি তা বুঝবেন না। আর আমি আপনাকে তা বোঝাতেও চাই না। সেটাই আপনার এবং আমার জন্য মঙ্গল।"
-"সামন্তবাবু,আপনি নিজেও জানেন আমি একজন সম্ভাবনাময় কবি। শুধু একটা স্কোপ চাই।"
-" জানি ভাই। আপনি অবশ্যই একজন সম্ভাবনাময় কবি। কিন্তু দু:খের বিষয় আমি আপনাকে স্কোপ দিতে পারব না। পশ্চিমবঙ্গের রাস্তাঘাটে এরকম হাজারো সম্ভাবনাময় কবিদের খুঁজে পাবেন। ওত কষ্ট করতে হবে না। বিভিন্ন সোশাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতেই যান না,লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীতের স্টাটাস ঘেঁটে দেখুন,লক্ষ লক্ষ কবিতা খুঁজে পাবেন। তাদের সবাইকে স্কোপ দিতে গেলে আমরা আর ব্যবসা চালাতে পারব না। আসলে তো ব্যবসাই করি তাই না! আমাদেরও বউ-ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে হয়।"
-" সামন্তবাবু আপনি জানেন যে আমার পাঠক আছে,যারা আমার কবিতা পড়ে। আপনারা দু-একটা চিঠিও পেয়েছেন। আপনাদের বিভিন্ন পুজো সংখ্যাগুলোর একটা-দুটোতে আমার কবিতা বের হয়। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ঘাটলেও আমার কবিতা পাবেন।"
-" আরে ধুর! আপনি এটাকে উনবিংশ শতাব্দি ভেবেছেন নাকি? লিটল ম্যাগাজিন এখন লক্ষ লক্ষ পাবেন। সেগুলোর আর পাঠক তৈরির ক্ষমতা নেই। সরি,একটু ভুল বললাম,,কবিতার পাঠক তৈরির ক্ষমতা নেই। এখন সবাই উপন্যাস খোঁজে ভাই। কোন বার্ষিকীতে কোন লেখক,কোন উপন্যাস লেখেছেন এখনকার পাঠক তা বলে দেবে। পূজাবার্ষিকীগুলো বিক্রিই হয় উপন্যাসের জন্যে। কবিতা পড়তে কজন পাঠক পত্রিকা কেনে???? 
এক কাজ করুন স্পর্শবাবু। একটা উপন্যাস লিখে ফেলুন। ছাপাবার চেষ্টা করব। উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে আপনাকে অনেক মানুষ চিনবে। তারপর কবিতা-তবিটা যা লেখার লিখবেন।"
-"সামন্তবাবু,আমি একজন কবি। আমার সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটবে উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে? এটা ভাবতেও পারি না!! তার থেকে একটা কাজ করুন না। আপনাদের পত্রিকা তো পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে নামকরা পত্রিকা। ওখানে আমার কিছু কবিতা নিয়ে একটা ক্রোড়পত্র বার করুন না। সাধারন মানুষের (পাঠকের) আমাকে চেনার এর থেকে ভালো উপায় আর কি থাকতে পারে!"
ভদ্রলোক এবার উচ্চস্বরে হাসলেন।
সাধারণত এধরনের হাসি মধ্যেরাতে হায়েনা'দের গলা থেকে শুনতে পাওয়া যায়। কি আশ্চর্য! !! ভদ্রলোককে এখন দেখাচ্ছেও হায়েনার মত। কিচ্ছুক্ষণ আগে ছুঁচোর মত লাগছিল না!
-"স্পর্শবাবু,এর মানে আপনি বলতে চাইছেন আমি আমাদের বৃহত্তম পত্রিকায় দেড়-পেজ জুড়ে আপনার কবিতার ক্রোড়পত্র বের করব... তাই তো?"
-"হুম্"
-"দেড় পেজ এর দাম আপনি জানেন?? ওই জায়গায় দুটো বিজ্ঞাপন দিলেই ৮ লাখ উঠে আসবে। আপনি কখনও দেখেছেন আমাদের পত্রিকায় দির্ঘপেজ জুড়ে আমরা কোনো অনামি লেখকের ক্রোড়পত্র বার করেছি?? "
- "আপনি আমার ক্রোড়পত্র ছাপাবার পরেই আমার কবিতা নিয়ে একটা বই বার করে ফেলুন না। রয়ালিটি লাগবে না। তাতেই টাকা উঠে আসবে।"
ভদ্রলোক আবারও হাসতে শুরু করলেন।
এবার আমি বিরক্ত লুকানোর চেষ্টা করলাম। কি এমন কথা বললাম যাতে এত হাসি পায়! আচ্ছা আমার মুখ কি এখন ছুঁচোর মত দেখাচ্ছে?
-" স্পর্শবাবু,আপনার ধারনা নেই আপনি কি বলেছেন। শুনুন,আমরা একটা উপন্যাস পূজাবার্ষিকীতে বের করি। সেই উপন্যাসএর টানে পাঠকরা পত্রিকা কেনে। তারপর আবার সেই উপন্যাসটাই মলাটে বন্দি করে দু-তিনশ টাকায় বাজারে ছাড়ি। আবারও তা বিক্রি হয়ে যায়। কেউ পত্রিকায় না পড়ার কারনে কেনে,,কেউ সংগ্রহে রাখার জন্যে কেনে। কবিতায় লাভ নাই ভাই। পূজাবার্ষিকীগুলোতে একটা-দুটোর বেশি কবিতা দেওয়া যায় না। আর একটা-দুটো কবিতা দুশো টাকায় বিক্রি হয় না স্পর্শবাবু। তাও ধরুন আমি আপনার একটা বই বাজারে বের করলাম। আপনি খুব ভালো লেখেন আমি জানি। হয়ত কিছু পাঠক কিনলো। তাদের ভালো লাগল। দু-একজন পাঠক আপনার নাম জানলো। নাম জানার সাথে সাথেই দেখবেন দু-একদিনের মধ্যে আপনার বই এর একটা পিডিএফ(PDF) ভার্সন বেড়িয়ে গেছে। টাকা খরচ করে কে কবিতার বই কিনতে যাবে? একশোর মধ্যে কিনবে একজন। হাজারে দশজন। তাদের ওই বই কেনায় আমার তো পেট চলবে না। আপনি ফেমাস হলেও আমার পেট চলবে না। আপনার নাম ছড়াবে পিডিএফ (PDF) এর মাধ্যমে। আপনি ফেমাস হবেন। আমরা প্রকাশকরা ডুবব। একটা উপন্যাস লোকে ধৈর্য ধরে ইবুকে পড়বে না। সবাই তা পড়তেও পারে না। কিনে নেবে। কিন্তু একটা কবিতা পিডিএফ এ পড়তে কোনো বাঁধা নেই। বুঁঝছেন???"
-"এই ইবুক-পিডিএফ এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে আমরা কি এক আছাড় মেরে রাস্তায় এনে ফেলছি না সামন্তবাবু?"
-"সেটা আমাকে বলছেন কেন? পাঠকদের বলুন। এজন্যই প্রতিবছর ডজনে-ডজনে লেখক জন্মাচ্ছে। কবি কটা জন্মায়? এক কাজ করুর স্পর্শবাবু,,পিডিএফ নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন। সামনের সংখ্যায় ছাপার চেষ্টা করব। হা হা হা।
স্পর্শবাবু এখনতো উঠতে হয়..একটু কাজ আছে। আপনি চা খাবেন??"
-"না"
-"খান এক কাপ। দিতে বলি?"
-"না থাক।"
প্রকাশনা থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসলাম।
আজ আকাশ মেঘলা,বৃষ্টি হব হব করেও হচ্ছে না। আমি এখন পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছি। প্রত্যেক রোববার এটাই আমার একমাত্র রুটিন। বিভিন্ন প্রকাশনায় হাঁটাহাঁটি করা। প্রায় পাচঁ বছর ধরে করে আসছি। আগে সপ্তাহে তিন-চারদিন এই রুটিন ছিল,একটা সরকারি চাকরি পাবার পর রোববার ছাড়া আর সময় হয় না।
রোববার দিনটায় সারাদিন আমি কিছু খাই না। খালি পেটে নাকি খুব ভালো কবিতা আসে। বহুবছর আগে 'একজন' একথা বলত। এখনো চোখের সামনে ভাসে সেই দিনগুলি। আমি পড়ার টেবিলে একমনে বসে কবিতা লিখতাম। 'ও' জানালা দিয়ে এসে বিরক্ত করত।
-"এই যে কবিসাব, কি করছেন?"
-"তিথি এখন লিখছি,বিরক্ত কর না।"
-"কি লিখছেন একটু বলুন তো। নতুন কি কবিতা,কবিতার নাম কি?"
- "নাম বললে তুমি বুঝবে?"
-"কবিতাই বুঝিনা,আর নাম! হা হা হা...."
বলেই 'ও' চুরি নাড়িয়ে হাসত। চুরির সেই রিনঝিন রিনঝিন শব্দে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠত।
-"কবিতার নাম হল 'তিথি'। "
'ও' লজ্জা মাখা গলায় বলত..
"ইস! অন্য কোনো নাম পেলেন না? আপনি খুব অসভ্য"।
-"অসভ্যের কি দেখলে,আমার পরের কবিতার নামও ঠিক করা হয়ে গেছে। কি নাম জান?"
-"কি??"
-"আদর।"
-"ইসসস দুষ্টু... আপনার সাথে আর কথা নেই।"
-"আপনি আপনি করছো কেন??"
-" নয়ত আর কি বলব? ওত বড় দাড়ি রেখেছেন। আপনাকে দেখাচ্ছে সাধুপুরুষের মত।"
-"কবিরা এরকম দাড়িই রাখে। রবি ঠাকুরের দাড়ি দেখনি?"
-"উনি কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে দাড়ি রাখতেন। তরুন বয়সে ওনার খুব সুন্দর গোঁফ ছিল। তোমার তো মনে হয় গোঁফই ওঠে নি। হাহাহা...."
বলতে বলতেই ওর চুরি আবার বেজে উঠত। মন স্পর্শ করে যেত সে শব্দ।...
পার্কে বসে মেঘলাদিনে এসব ভাবছি। ঘোর কাঁটল এক বাদামওয়ালার ডাকে-
'বাবু,বাদাম লিবেন?'
-"টাকা নেই ভাই। আজকের দিনে আমি টাকা নিয়ে বেড়াই না। আমাকে বিভিন্ন প্রকাশনায় ভিক্ষা করে বেড়াতে হয়। তবে তুমি যদি একঠোঙা বাদাম দাও,মূল্যবান একটা জিনিস পাবে।"
-"কি?"
-"কবিতা। আমার লেখা নতুন একটা কবিতা"।
বাদামওয়ালা আমাকে অবাক করে একঠোঙা বাদাম দিয়ে বলল
-'কন। একখান কবিতা কন। শুনি।'
আমি বলতে শুরু করলাম....
"খুব সম্ভবতঃ একজন প্রেমিক ছিল সে, 
কাগজের ভাঁজে গোপনে জমাতো জোছনার জল, তারার সুর, ক্ষয়ে পড়া পালকের মত দীর্ঘশ্বাস কিছু।..
নৃশংস ছাই হয়ে ঝরে যেতে যেতে একদিন জেনে গেলো-
এই শহরে নির্ঘুম সোডিয়াম লাইটেরা নিশ্চুপ থেকে সারারাত শুধু প্রায়শ্চিত্তের কথা ভাবে।
মাছরাঙার নীল ডানায় প্রতীক্ষায় না থেকে একদিন-
বহুবার করে বাঁচার সাধ হল তাঁর-কবিতার।
ধ্বংসস্তূপের মাঝে নতুন পৃষ্টা, ছাই ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ঝলমলে বাজ ফিনিক্স। 
মাছির চোখের দ্যুতি নিয়ে পৃথিবীকে দেখছিল, নতুনভাবে, হাজার রাত্রির রূপকথা- যেন গুঁড়িয়ে যাওয়া শত টুকরো আয়নার ভেতর শত শত কবিতা'কে।
যা কোনোদিন কোনো মলাটে ঠাই পাবে না।........."
হঠাৎ কবিতা থামিয়ে আমি বাদামওয়ালাকে ত্বারস্বরে জিজ্ঞেস করলাম
-"চুরির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?? রিনঝিন রিনঝিন চুড়ির আওয়াজ??"
তিনি গভীর বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।।

1 comment: