Monday 29 June 2015

গৌর-চন্দ্রিকা ~ সায়ন মুখার্জ্জী

সায়ন মুখার্জ্জীর চোখে বৈষ্ণব-পদাবলী ~



ভূমিকা-- এটি বৈষ্ণব-পদাবলীর প্রথম পর্যায়, গৌর-চন্দ্রিকা পর্যায়ের। বিভিন্ন পদকর্তা-গণ এ-বিষয়ে এতো মহান মহান পদ লিখেছেন যে এটা পড়ে ক্ষমা-ঘেন্না করে দেবেন। এই ছড়ার সঙ্গে পদাবলীর দূর-দূর থেকে কোন সম্পর্ক নেই...

প্রেক্ষাপট-- দীক্ষা নিয়ে নদের-নিমাই হয়েছেন, মহাপ্রভু-শ্রীচৈতন্য দেব। তাঁর কৃষ্ণ-প্রেমে আকুল নদীয়া তথা গোটা বাংলা-উড়িষ্যা-বাসী।
তিনি যে শুধু-মাত্র বৈষ্ণব-ধর্ম প্রচারক নন, তিনি এক-জন সমাজ-সংস্কারক-ও বটে। সমাজে যেখানে যা অন্যায় ঘটে, তার-ই প্রতিবাদে তিনি গর্জে ওঠেন। সমাজের মাথারা তাই তাঁর বিরুদ্ধে এক হয়ে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।

সেই সময় নদীয়ার কোতোয়ালের দুই-ছেলে "জগ্ননাথ" ও "মাধব", 'জগাই','মাধাই' নামে কু-খ্যাত ছিলেন। কর আদায়ের জন্য হেন নীচ কাজ নেই যে তারা করত না। তাদের মতো পতিত-দের উদ্ধার করার জন্য, মহাপ্রভু অনেক চেষ্টা করেন ও অকাতরে প্রেম বিলান, কিন্তু কিছুতেই তারা পাপের পথ ছেড়ে দিতে রাজী নয়।

তখন প্রভু-নিত্যানন্দ, যিনি মহাপ্রভুর অন্যতম শিষ্য ও বন্ধু এর জন্য এগিয়ে এলেন। পথের ধারে মাংস ও মদের পাত্র নিয়ে বসে থাকা ২-ভাইয়ের সামনে তিনি কীর্তন করতে থাকেন। তাদের ২-জনকেও কৃষ্ণ-নাম করার জন্য বার-বার অনুরোধ করতে থাকেন। বিরক্ত 'মেধো' তখন মদের মাটির পাত্র ছুঁড়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেন। তখন প্রভু নিত্যানন্দ বলেন, " মেরেছিস কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না !'

ও-দিকে নিতাই-প্রভুর আহত হওয়ার খবরে ক্রোধে অধীর মহাপ্রভু ছুটে আসেন তাঁদের সামনে। তিনি এই-দুই-অসুর-কে হত্যার জন্য আকাশের দিকে আঙুল করে তাঁর সুদর্শন-চক্র কে আহ্বান করেন। তাঁর মাথার পিছনে ১-টি দিব্য-চক্র সৃষ্টি হয়। ও-দিকে নিতাই-প্রভু, নিমাই-মহাপ্রভু-র পা ধরে বারংবার ওদের কৃত-কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। এই ঘটনায় কিছুটা বিরক্ত ও ততোধিক বিস্মিত মহাপ্রভু।

এর পরেই এই কাব্যের উপস্থাপনা। বৈষ্ণব-শাস্ত্র অনুসারে নিমাই-মহাপ্রভু শ্রী-কৃষ্ণের, নিতাই মহাপ্রভু শ্রী-বলরামের অবতার।
পদ্যের ১-ম অংশ-টি মহাপ্রভুর, ২-য় অংশ-টি নিমাই প্রভুর, ৩-য় অংশ-টি অভাগা-কবির বক্তব্য।

১।
কেন ? ও-দের ব্যাথাতে তুমি, হও-গো ব্যাকুল--
ওরা কি ভাঙেনি ? ও-গো তোমার-ই দু-কূল --
আজি, এ-ঝড়ে যদি, ও-রাহু-কেতু মরে--
তাতেই লুটিবে তুমি--দুই-জোড় কড়ে---
মাথা নত করে !!!
কোথা জমা রাখো, তুমি এত প্রেম-বিন্দু ?
কেনো সে যায় না বয়ে, হে ক্ষমা-সিন্ধু !!!
আঘাতে ওদের তুমি, হও না কি জীর্ণ ?
কভু, হও কি বিদীর্ণ ???
তারে এত দ্রুত, তুমি কর, কেমনে ক্ষমা ?
মনেতে যাদের, ও, কালকূট জমা।
কতই-সেধেছি, আমি ওরে, ভজনার-ই তরে,
কইতে বলেছি, কৃষ্ণ-নাম, পরিত্রাণ তরে।
শোনে-নি-তো, এরা-ও বন্ধু, যেমন, শোনে-নি-কো ওরা--
তাই তো ত্রেতা-যুগে রাবণ মরে--দ্বাপর কংস হারা !!!
তাই আমি ডাকি, দিব্য-চক্র, করতে ওদের, সর্বনাশ--
এ-ধরিত্রী, ঠাণ্ডা হবে, হলে পড়ে, ওদের মুণ্ড-নাশ।।।

২।
আপনি প্রভু, আপনি পিতা--
আপনি হলেন, রাজার-রাজা--
শাস্তি ওদের দিতেই পারেন, 
পেতেই পারে, ও-রা সাজা।
কিন্তু প্রভু, এ-যে ঘোর-কলি--
যদি, অভয় দেন, তবে ২-টো কথা বলি--
এই যুগে-তে, সবার মনেই, শয়তানের-ই-বাস--
সবার ঘাড়েই সবাই ফেলে, বিষাক্ত-নিশ্বাস--
কয়জন-কে দণ্ড দেবেন ? ক-জনা পাবে শাস্তি ?
ভয়ে-তে লোকে শ্রদ্ধা করবে, প্রভু-প্রেমের ঘরে নাস্তি--
তাই তো প্রভু, প্রেম বিলাই-ছি--
ও-কলস আঘাত, মাথায় ল-য়েছি-
প্রভু, ও-কলস-ও, কভু, মাটির ছিলো--
কুমোর চাকেতে-লয়ে, খুব খেলে-ছিলো-
কিন্তু, ও-মাটি-ই যেই, শক্ত হল--
ওর ধর্ম-বর্ণ, বদলে গেলো।
প্রভু, প্রেম-লীলা ঠিক-তেমনি বট-ই--
শক্ত-পাষাণ-ও-হয়, গঙ্গা-মাটি ।।।

৩।
ও শ্রী-রূপ দেখিয়া ও শুনিয়া বিবিধ--
ডুকরে কেঁদে ওঠে, দস্যু-জগা ও মেধো-
ষাষ্ঠাঙ্গে শুয়ে পড়ে, প্রভু পাদ-পদ্ম, চুমি--
ত'-গো অশ্রুতে, শীতল হয়, তপ্ত-বঙ্গ-ভুমি--
" মোদের মতো পতিত, প্রভু, পাবে কি কভু দীক্ষা--
অসাধ্য-ও, করব সাধন, পেলে প্রভুর শিক্ষা।"
এতেক দেখে, জল এসে যায়, দুই-প্রভুর-ই চক্ষে--
দুই-পাপী-কেই, জড়িয়ে ধরেন, নিজের নিজের বক্ষে।
জনতা দেন, হর্ষ-ধ্বনি, সকলে নাচেন দু-বাহু-তুলি--
দুখী-মনে-তে ভাবেন কবি --
হায় ! কেন সে-যুগে, না পাঠালেন ভবী ।।

No comments:

Post a Comment