পুস্তক আলোচনা,
অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়
বইঃ- “মানুষ অতুলপ্রসাদ”
লেখকঃ- পাহাড়ী সান্যাল
প্রকাশকঃ- সপ্তর্ষি প্রকাশন
দামঃ- ১৫০ টাকা
কয়েকদিনে পড়ে শেষ করলাম এই স্বল্পাকৃতি বইটি।
মিস্টার এ.পি.সেন থেকে ‘অতুল’দা’... অতুলপ্রসাদ সেনের সাথে পাহাড়ী সান্যালের ঘনিষ্ঠতা ছিল এই পর্যায়ের। ব্যক্তি অতুলপ্রসাদকে, তাঁর নিঃসঙ্গ গান-জীবনকে অন্তরঙ্গে দেখেছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। সেই দেখারই এক আশ্চর্য সচিত্র আখ্যান এই বই।
১৯৭১ সালের ৯ই অক্টোবর ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয় এই স্মৃতিচারণের প্রথম কিস্তি। কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়না। তার আগেই প্রয়াত হন পাহাড়ী সান্যাল। তবু পত্রিকায় প্রকাশের ঠিক চার দশক পরে, ২০১২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এই বই। বইয়ের কথামুখে সম্পাদক অর্চি মিত্র বলেছেন- “সংগীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যত আলোচনা বাংলা সংগীতসাহিত্যে তার পরবর্তী স্রষ্টাদের নিয়ে তার এক দশমাংশও বোধহয় নয়। সামগ্রিক ভাবে বাংলা ভাষায় সার্থক সংগীতসাহিত্য কততটুকুই বা আছে সে প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন। কিন্তু ঘটনা হল, যেটুকু আছে অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালেরা সেখানে বিশেষ আলোচিত হননি বললেই চলে”। তাই অসম্পূর্ণ হলেও পাহাড়ী সান্যাল রচিত এই বিস্মৃতপ্রায় আখ্যানকে পুনরায় পাঠক সমুখে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ। যদিও এই লেখা সংগীতস্রষ্টা অতুলপ্রসাদকে যতনা বিশ্লেষণ করে তার চেয়ে বেশী করে তুলে ধরে অতুলদা’র সাথে তাঁর প্রিয় পাহাড়ীর সম্পর্ককে। হয়ে ওঠে ত্রয়োদশবর্ষীয় বালক পাহাড়ী ও মধ্যবয়সী অতুলপ্রসাদের অসমবয়সী বন্ধুত্বের চিত্রাঞ্জলি। এ লেখা তাই বড়ই ব্যক্তিগত। এবং কখনও কখনও একই কথার পুনরাবৃত্তিতে দুষ্ট (যদিও এই পুনরাবৃত্তির জন্য পাহাড়ী বাবু তাঁর লেখার মধ্যেই বারে বারে ক্ষমা চেয়েছেন পাঠকদের কাছে)। তবুও এই লেখার মাধ্যমে অতুলপ্রসাদের মতন গুণী মানুষের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন, পাহাড়ী বাবুর নিজের শৈশব ও কৈশোরের দিনরাত ও তাঁর প্রথম প্রেমের আখ্যান, তৎকালীন লক্ষ্ণৌ-এর জীবন, তার সংস্কৃতি এবং সেই জীবন ও সংস্কৃতিতে অতুলপ্রসাদ ও তৎসহ বাঙালী কমিউনিটির প্রভাব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।
কিন্তু এতসব সুন্দরের মধ্যেও কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে এর অপটু প্রকাশনা। বইয়ের বাঁধাই কিংবা প্রচ্ছদ অথবা কাগজের মান নিয়ে বলছিনা। বলছি অসংখ্য মুদ্রণ প্রমাদ নিয়ে। যতি চিহ্নের এলোমেলো অবস্থান নিয়ে। পাহাড়ী বাবুর মতন এমন বিদগ্ধ মানুষ যখন কিছু রচনা করেছেন তখন আমরা ধরে নিতেই পারি যে তিনি নিশ্চয়ই এমন বালখিল্যের মতন প্রমাদগুলি ঘটাননি। এমন ভাবাটাও অস্বাভাবিক নয় যে, যে সময় এই লেখা ছাপা হয় ‘দেশ’ পত্রিকায় তখন তার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ, তাঁর মত পণ্ডিত মানুষের চোখও নিশ্চয়ই এড়ায়নি! তাহলে তো এই-ই দাঁড়াল- এ ভুল বর্তমানকালের প্রকাশক ও সম্পাদকের। এমন একটি ইতিহাসের অংশকে যখন কাগজের আশ্রয়ে তুলে ধরা হয় জনসমক্ষে তখন কি আরও সচেতন হওয়া উচিৎ নয়?! আরও বড় কথা আমি যে বইটি পড়েছি সেটি দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৩! অর্থাৎ পরপর দুটি সংস্করণ ধরে এই ভুলগুলি চোখের আড়ালে লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে! হায়রে বঙ্গীয় প্রকাশক! তবু আশায় বাঁচে চাষা! আশা রাখি এর পরবর্তী সংস্করণগুলিতে পাহাড়ী ও তার অতুলদা’র জীবনালেখ্যের প্রমাদমুক্তি ঘটবে।
পুনশ্চঃ- আনন্দবাজার পত্রিকার “রবিবাসরীয়”-তে প্রকাশিত আশিষ পাঠক রচিত অতুলপ্রসাদের নিঃসঙ্গ ও বেদনাময় ব্যক্তিজীবন নিয়ে রচিত “একার গান” রচনাটিও পরিশিষ্ট হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে এই বইয়ে।
No comments:
Post a Comment