Wednesday 24 June 2015

প্রবন্ধ : লওণ্ডা নাচ ~অভীক মুখার্জী



লওণ্ডা নাচ নিয়ে কিছু কথাঃ
কাল রাতে ‘সাবধান ইনডিয়া ইউ . পি. ফাইটস ব্যাক’ –এর একটি পর্বে দেখছিলাম ‘লওণ্ডা নাচ’ নামক পেশাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনার ব্যাপারে।
ছোট গল্প। ভানু নামের একটি ছেলে সদ্য সাবালক হবার পরে বাড়ির অভাবের তাড়নায় ‘নাচনিয়া’ (পুরুষ হয়েও মেয়েলি পোশাকের অন্তরালে থেকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে অশ্রাব্য গানের তালে তালে নাচে যে) পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তার পিতাও এই পেশায় লিপ্ত ছিলেন। পিতাকে জোর করে রাজি করিয়ে এবং মাকে লুকিয়ে ছেলেটি খুব অল্প দিনের মধ্যেই লওণ্ডা নাচিয়ে হিসাবে বেশ নাম করে (ভানু হয়ে যায় ভানুপ্রিয়া) এবং ভালো টাকা রোজগার করতে থাকে। কিন্তু জীবন সোজা পথে এগোয় না। ডাক পড়ে এক স্থানীয় মুরুব্বির মেয়ের বিয়েতে নাচার জন্য। সেখানে নাচার সময় ছেলেপক্ষের একজনের নেকনজরে (!!!) পড়ে যায় ভানুপ্রিয়া, তাকে ৫০,০০০ টাকার নগদ ইনাম দেওয়া হয়। কিন্তু ইনাম প্রদানকারী কমবয়সী ছেলেটি বুঝে উঠতে পারেনা যে ভানুপ্রিয়া মেয়ে নয় ছেলে (এতই ভালো ছিল ভানুপ্রিয়ার অভিনয় আর নাচের দক্ষতা)। মেয়ে পক্ষের কিছু মানুষ ইনাম প্রদানকারী ছেলেটির সাথে কদর্য রসিকতার তালে ভানুপ্রিয়া’কে তুলে আনে রাতে ছেলেটির ঘরে (তাতে সাহায্য করে ভানুপ্রিয়ার নাচনিয়া দলের এক পুরানো নাচনিয়া, যে ভানুপ্রিয়ার ক্রমোন্নতি দেখে জ্বলে যাচ্ছিল)। ইনাম প্রদানকারী ভানুপ্রিয়া’কে বলাৎকার করতে গেলে প্রকাশিত হয়ে পড়ে ভানুপ্রিয়া আসলে ভানু। ভানু সেই মুহূর্তে পালিয়ে গেলেও ছেলে পক্ষের ইজ্জৎ নিয়ে মেয়ে পক্ষের মানুষ ‘খেলা’ করায় তার মাসুল দিতে হয় ভানুর প্রাণ দিয়ে। পরে এই গল্পে (সত্য ঘটনা) পুলিশের সাহায্য নিয়ে অপরাধী ধরা পড়ে।
ওপরের যে কাহিনী বিবৃত করলাম এরকম রোজকার জীবনে ঘটে থাকে ভারতীয় গো – বলয় এর Eastern U.P. , Bihar ইত্যাদি অঞ্চলে। লওণ্ডা নাচ এখানে খুব সাধারণ ব্যাপার। প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে এই নিয়ে পড়া, তথ্য খোঁজার কাজ শুরু করেছিলাম, কিছু পেয়েওছি। কি অদ্ভুত জীবন এদের সেটা না পড়লে, না দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হয় আমরা শুয়ে আছি, না ঘুমানোর কথা বলিনি, বললাম শুয়ে আছি। যে অর্থে শুয়ে থাকা তা হল নিজেদের গা বাঁচানো, যেমন মানুষ বাঁচায় বোমার আঘাত, গুলির আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে, আমরা জেনেও চুপ করে থাকি।
সামান্য কিছু অর্থের চাহিদায় পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অন্ধ্র, ওড়িশা থেকে কম বয়সী ছেলেরা উপরোক্ত অঞ্চলে ভিড় জমায় ‘নাচনিয়া’ হবার তাগিদে। এর মধ্যে প্রভেদ থাকে; কেউ শুধুই টাকার জন্য মেয়ের পোশাকে নাচে, কেউ মেয়েলি স্বভাবের তাই এই পেশা বেছে নেশার সাথে মিশিয়ে নেয়, অনেকে আবার নিজের লিঙ্গ কর্তন (লিকম ছিবড়ানো, লিকম= লিঙ্গ) করিয়ে হিজড়াদের খোলিতে নাম লিখিয়ে এই পেশায় আসে।
ভারতীয় গো – বলয় এর Eastern U.P. , Bihar ইত্যাদি অঞ্চলে বিয়ের বরযাত্রী বা ‘বারাতি’ এলে তাঁদের নেচে ‘স্বোয়াগত’ করতে / ‘বারাতি’র দলের সামনে নেচে নেচে আসার জন্য লওণ্ডা নাচিয়েদের দরকার হয়। ইতিহাস বলছে প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই প্রথার প্রচলন। মেয়েদের পর্দানশীন হবার কারণে ছেলেরাই এই পেশায় নাম লেখায়, তাছাড়াও মূলস্রোত ব্যতীত হিজড়া সমাজের মানুষ এতে অংশ নেন।
নাচ চলতে থাকে, রাত বাড়তে থাকে। মদের ফোয়ারার ছটকানিতে বারাতির দল ভুলে যায় নাচনিয়াদের লিঙ্গ (অবশ্য বিকৃত কাম লিঙ্গ ভেদ দিয়ে বিচার করা মূর্খের কাজ, যে বিকৃত কামের অধিকারী সেই ব্যক্তি সমাজের গায়ে একটা ঘা’য়ের মতই, নারী জাতির অবমাননাকারী প্রত্যেক মানুষ এই বিকৃত কামের অধিকারী ) , তাদের নিয়ে টানাটানি বাড়তে থাকে, নাচের রঙ্গে নেশা ধরাতে নাচনিয়ার দল যে পিঠের বেশি ভাগ খোলা ‘চোলি’ পড়ে থাকে সেই উম্মুক্ত পিঠে পড়তে থাকে পুরুষের হাত, ‘বন্ডেজ’প্রিয় বারাতির ব্লেড ছিন্ন ভিন্ন করে নাচনিয়া লওণ্ডার দেহ, রক্তে – স্বেদে দুর্দমনীয় পৌরুষ এর পরে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায় লওণ্ডা নাচের নায়িকাদের (নায়ক!!!)। এক নয়, দুই নয় বেশি ভাগ ক্ষেত্রে ১২-১৪ জনের হাতে ধর্ষিত হতে হয়েছে বলেই গড়পড়তা হিসাব মেলে।
তবে শুধু বারাতির বরাত নিয়ে নাচা নয়, কিছু ক্ষেত্রে মেলায়, অনুষ্ঠানে নাচার জন্যেও নাচনিয়াদের ব্যবস্থা করা হয়। নাচনিয়া খোলির মালিক এসব ব্যাপার দেখে থাকেন। আবার অনেক সময় রহিস জমিনদার দের বাড়িতে পাকাপাকি নাচনিয়াকে ক্রীতদাসের (ক্রীতদাসী!!!) মত রাখা হয়। ক্রীতদাস বলা বোধ হয় ভুল হবে, বলা যেতে পারে যৌনদাস হিসাবে। সেখানে কিছুটা খেতে পাবার জন্য বার বার তাকে ধর্ষিত হতে হয় জমিনদার, তার পরিজন, চাকর এদের হাতে; এমনকি প্রাতক্রিয়া সারতে মাঠে গেলেও শিকার হতে হয় এদের। কি অদ্ভুত লাগছে না! তার থেকেও বেশি গা – শিউরে ওঠা ভাব আসছে না! কিন্তু কিছু করার নেই লওণ্ডা নাচের নায়ক (!!!)দের। শেষ অব্দি বেশি ভাগ ক্ষেত্রে কোন দুরারোগ্য যৌন ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে স্থান হয় রাস্তার ধারে, জীবনের শেষের ওখানেই শুরু হয়।
ঋণস্বীকারঃ 
১. গুরুচণ্ডালী ওয়েবম্যাগ
২. ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার ১৪২১ শারদ সংখ্যা
৩. ইন্টারনেট থেকে নানা সংকলিত তথ্য
৪. নিজস্ব গদাসম দৃষ্টিভঙ্গী

No comments:

Post a Comment