Friday 26 June 2015

পুস্তক পর্যালোচনা ~ অনীশ ভৌমিক

অনীশ ভৌমিকের ‎পুস্তক পর্যালোচনা:-      
পুস্তক:“মায়াকাচ”
লেখক:  তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় 
প্রকাশক: আনন্দ প্রকাশনী
দাম:১৫০/- (ইং ২০১২,)

মফস্বলের অন্তর্মুখী ও ভাবুক তরুণ কৃষ্ণেন্দু আশৈশব তার কাকাদাদু তপনকান্তির সাহচর্য্যলাভ করায় তাঁর দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। আদর্শবাদী ও একসময়ের নরমপন্থী সাম্যবাদী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য অববিবাহিত তপনকান্তি নিজের অনমনীয় ধ্যান-ধারণার কারণে অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন “সম্পৃক্ত দ্রবণে ভাসমান অদ্রাব্য বস্তুর মতো” পারিবারিক-জীবনে নিতান্তই প্রান্তিক এক সদস্য। সামাজিক উপেক্ষার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কৃষ্ণেন্দুর মধ্যেই তাই তপনকান্তি নিজের অচরিতার্থ ইচ্ছেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবার অলক্ষ্যে কিছুটা স্বেচ্ছাচারীর ঢঙে বপন করে দিয়েছিলেন এক তথাকথিত অচল ও বাস্তব-সাপেক্ষে অনুপযোগী জীবনবোধ। এদিকে স্বভাবগতভাবেই গতানুগতিকতার প্রবল বিরোধী হয়ে ওঠা কৃষ্ণেন্দু সাহিত্যের ছাত্র হবার পর থেকেই যেতে চায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সহজ সাবলীল জীবনযাপনের বিপরীতে , পদে পদে নিজের ভুলভ্রান্তি-পরবর্তী আত্মসমীক্ষা ও আত্মকরুণার পৌনঃপুনিকতা সত্ত্বেও সে ‘শিল্পকলা’ নামক সময়োত্তীর্ণার সাধনার উচ্চাকাঙ্খায় অন্যমনস্ক । নিজের অপ্রচলিত চিন্তাভাবনার দৃঢ়তায় বরাবরের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে ক্রমশই যখন ছাত্রছাত্রীমহলে কৃষ্ণেন্দুর ভাবমূর্তি হয়ে উঠছে নিতান্তই ‘এক সৌজন্যহীন, অহঙ্কারী ও আত্মকেন্দ্রিক যুবক’ হিসেবে, তখনই সে অযাচিতভাবে সান্নিধ্য পায় মিশুকে সহপাঠিনী নন্দিনীর। চেহারায় বিন্দুমাত্র দৃষ্টি-নান্দনিকতাহীন নন্দিনীর শুভাকাঙ্খা ও শর্তহীন মানসিক সমর্থন পেয়ে কৃষ্ণেন্দুর একাকিত্বে জর্জরিত, সঙ্গলিপ্সু অহম্‌ চরম তৃপ্তিতে স্ফীত হয়ে উঠলেও , প্রতিনিয়ত তাকে করতে হয় ইন্দ্রিয়-দাসত্ব থেকে মুক্তির মানবিক সাধনা। পারিবারিক অশান্তির অভিঘাত, আসন্ন পরীক্ষায় নিজের প্রস্তুতিহীনতার উপলব্ধি এবং নিজের অসহায়তাজনিত প্রবল হতাশায় ক্রমাগত বিপর্যস্ত কৃষ্ণেন্দুর শারীরবৃত্তীয় দর্শনক্রিয়ার যান্ত্রিকতার কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে, দৃশ্যপটের প্রতিবিম্বকে মস্তিস্ক-সঞ্জাত হবার আগেই কোনো কল্পনা-প্রসূত ‘মায়াবী কাঁচ’ দিয়ে তাকে কাঙ্খিত রূপদান করার এক অলীক ও হঠকারী প্রচেষ্টার পরিণাম কি ধ্বংসাত্বক হতে পারে—তারই এক অসাধারণ ও মোহময় আখ্যান রয়েছে এই উপন্যাসে।

“ঘাতক”-নামক আরেকটি ‘আধুনিক পরিবর্তনশীল মনস্তত্ব’-বিষয়ক অনুপম উপন্যাস দিয়েই লেখকের সৃষ্টির সাথে আমার প্রথম পরিচয়। কিন্তু, ‘মায়াকাচ’ পড়ার পর এ কথা বলতে পারি যে অনবদ্য পরিবেশনশৈলী ও অত্যুত্কৃষ্ট শব্দবন্ধন সহকারে যেরকম সযত্নে এই সুখপাঠ্য কাহিনীটির অবতারণা করা হয়েছে – তাতে পাঠকের মানসপটে এক দীর্ঘস্থায়ী মুগ্ধতাক্ষেপণে লেখক স্বয়ং যেন এবার এক ‘ঘাতক’-এর ভূমিকায়!

No comments:

Post a Comment