Sunday 21 June 2015

ছুটিতে ইতিহাস তৈরি হয় না ~ অভীক মুখার্জী

ছুটিতে ইতিহাস তৈরি হয় না ~ অভীক মুখার্জী 
-----------------------------------
ফেব্রুয়ারির হাওয়া জানান দিচ্ছে গরম আসতে খুব দেরি আর নেই; নরেশের দোকানের শিঙাড়ায় ফুলকপি কমে যাবে, কাঁচের শিশিতে জমে যাওয়া নারকোল তেল আর গলিয়ে মাখতে হবে না, ছোট জলাগুলো শুকোতে থাকবে; ঐ যে বললাম, গরম আসতে খুব দেরি আর নেই।
আমার আকাশ – বাতাস চমকানো ঈশ্বর – পৃথিবী – ভালবাসা মাথায় নিয়ে কৃষ্ণরামপুর বাজার থেকে হেঁটে যাচ্ছি বদরতলার দিকে, চোখে পড়ল একটা চেনা চেনা মানুষ। মানুষটা চেনা নাকি বলা মুশকিল হলফ করে, চেনা হলে তো একবারেই চিনে ফেলতাম; অচেনাও নয় তাহলে চিনতে চেষ্টাই করত না আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্ক।
উলটো দিক থেকে হেঁটে আসা একটা অবয়বকে খুব দ্রুত মাথার ভিতরে সার্চ করে বেরাচ্ছি, যাতে চিনে নিয়ে কিছু একটা বলতে পারি, কারণ চোখের সামনে দেখছি যিনি আসছেন আমার উলটো দিক থেকে তিনি আমার দিকে স্মিত হাস্য পাত করেই আছেন।
এই আমার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, এতেই আমি আস্থা রাখি, ঐ বয়সের কেউ আমার স্যার না হলেও স্যার বলে ডাকতে কাউকেই দোষ হয় না, স্যার মানে মহাশয়, মানে স্যার ডাকে সবাইকেই সইয়ে দেওয়া যায়।
-স্যার ভাল আছেন?
-চিনতে পারলে তবে?
-হ্যাঁ স্যার, আপনাকে চিনব না! সেকি কথা!
-না, এখন আমি অনেককে চিনতে পারি না তো, বয়স হয়ে গিয়ে নার্ভগুলো আর কাজ করে না। ঐ যে অলফ্যাকটরি নার্ভের কি একটা প্রবলেম বলেছিল সচিন ডাক্তার... মমমমম... মনে পড়ছে না।
মনে পড়ে গেছে ততক্ষণে আমার, রবিন বাবু, রবিন হালদার, আমাদের, মানে আমার মাধ্যমিকের টিউশনের বিজ্ঞান টিচার, রবিন বাবু। সামান্য একটা অলফ্যাকটরি নার্ভের উল্লেখ আমাকে মনে করিয়ে দিল বিজ্ঞান স্যারের কথা, নাহলে মনেই করতে পারছিলাম না। যেন এক দশকে পেরিয়ে গেছেন অর্ধ শতক। সেই চোখের দীপ্তি, মুখের লালিমা, প্রশস্ত বপু সব কালের কপোলে নোনা জলের ধারার মত হারিয়ে গেছে; ঘোলাটে চোখ, তামাটে মুখ, কোলকুঁজো দেহ নিয়ে রবিন স্যারের সেই পুরানো ছবি ইতিহাসের মত লাগল আমার মনের কোনও এক কোঠায়। যেমন কুষাণ সম্রাট কনিস্কের স্কন্ধ কাটা মূর্তির ছবি দেখেছি জীবন মুখোপাধ্যায়ের ইতিহাস বইতে, ঠিক তেমনি আমার বিজ্ঞান স্যার দাঁড়িয়ে আমার সামনে।
- এইরে একটা ভুল করে ফেলেছি মনে হচ্ছে, অলফ্যাকটরি নার্ভের কথা বললাম কিনা! ওটা বোধ হয় ঘ্রাণের কাজে লাগে, মনে নেই কিসে মনে থাকার কাজ হয়। মনে পড়ছে না। তোমার নামটাও মনে পড়ছে না, কিছু মনে কর না, খুব চেনা লাগল তোমাকে তাই দাঁড় করিয়ে দিলাম আর কি। নামটা যেন কী.... মমমম....অরিন্দম?
- না স্যার আমি মৃদুল; ২০০৫ সালের মাধ্যমিক ব্যাচ। মনে পড়ছে?
- না এখন তেমন মনে পড়ে না। অনেককেই চিনতে পারি না বললাম যে, অনেকে আমাকেও চিনতে পারে না।
দেখছ তো কি হাল আমার। আমি তো স্কুলের মাস্টার নই যে পেনসন মিলবে! টিউশন করতে পারি না এখন, ঐ যে কিচ্ছু মনে থাকে না, পড়াব কি! ভুল হয়ে যাচ্ছিল, ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলতে হলে নেতা হতে হত, কোনও স্যার কি তার ছাত্র – ছাত্রীর নেতা হতে পারে নাকি?
এখন সবাই আমাকে দেখলে ভয় পায়, সরে যায়, কথা বলে না, যদি আমি ধার চাই।
বুঝলাম রবিন স্যার এখন সমাজে ব্রাত্য।
- তা তোমাকে তো অনেকদিন দেখিনি, থাকো কোথায়?
- চাকরি করি স্যার। মুর্শিদাবাদে থাকি। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট।
- তাই নাকি! এটা জানতাম না তো!
বলতে গেলাম, ‘সেকি স্যার সবাই তো জানে’। পারলাম না, থামতে বাধ্য হলাম, টের পেলাম আমি এমন কিছু হাতি ঘোড়া বশ মানাইনি যে তার জন্য আমাকে এক ডাকে চিনতে হবে।
- তা ভালো। মুর্শিদাবাদ ভালো জায়গা। ঐতিহাসিক স্থান। আমি বিজ্ঞান পড়াতাম বটে, কিন্তু ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়তাম। এখন আর পড়ি না, মনে রাখতে পারি না। তা ঘুরে দেখলে বাচ্ছাওয়ালি কামান, সিরাজের খাবার প্লেট, আজিমুন্নেসার কবর? দেখলে... দেখলে....মমমম....?
ইতিহাস নিয়ে ব্যস্ত আমার বিজ্ঞান স্যারকে ফিরতি উত্তরে বলব কেমন করে যে আমার ঐসবে উত্সাহ নেই। ভাবছি যে কেনই দেখা হল, একটা খ্যাপাটে লোক রাস্তায় বেশ উত্তেজিত ভাবে আমাকে প্রশ্ন করছে দেখে অনেক চেনা অচেনা মানুষ দেখছে।
- না স্যার দেখা হয়নি, দেখে নেব, সময় হলেই দেখে নেব।আসলে কাজের খুব চাপ জানেন তো। ছুটির দিনে গিয়ে দেখে নেব।
বিশ্বাস করুন আমি অমন জ্বলন্ত অথচ করুণ দৃষ্টি কোনও দিন দেখিনি। এক পাত্রে আগুন আর জল দুটো সহাবস্থান করানো সম্ভব হলে যেমন দেখাত ঠিক তেমনি লাগল স্যারের চোখ।
- তুমি জানো কি, History has no holiday? তেমনি জেনে রাখো, ছুটিতে ইতিহাস তৈরি হয় না।
রবিন স্যার আর দাঁড়ালেন না, অসীম বিরক্তি, অদ্ভুত রাগ নিয়ে জায়গা ছেড়ে হাঁটা দিলেন।
আমি কিঞ্চিত স্তম্ভিত, হতভম্ব।
স্থাণুবৎ দণ্ডায়মান আমি। পাশের ওল্ড বেনারস রোড ধরে ছুটে যাচ্ছে ধর্মতলা – গড়েরঘাট রুটের বাস, মহীনের চায়ের দোকানে টুংটাং শব্দের জিগির তুলে কাঁচের গেলাসে চিনির বিয়ে গরম জলের সাথে, অনুপম রায় গাইছে 98.3 FM Radio তে, ‘বসন্ত এসে গেছে...’।
মাথায় একটা কথাই ভাসছে, ‘ছুটিতে ইতিহাস তৈরি হয় না’।

No comments:

Post a Comment