Thursday 18 June 2015

কালোসোনা-বজ্রদীপ সাহা

তখন পরন্ত বিকেল। আকাশে সবে সোনালী ছোপ ধরেছে। মশারা তাদের রাত্রি ব্যাপী অভিযানের মহড়ায় ব্যাস্ত। কালকের অকালবর্ষনের জলে মাটির উঁইপোকা গুলোর ডানা গজিয়ে ‘অভি’ তে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা মাটি ফুরে একে একে উড়ান দিচ্ছে ‘অকাল মরণের’ দিকে।চারপাশের বাড়ি গুলো সব প্লট করে বানানো। দোতলা বাড়ি, উঠান আর এক খাবলা বাগান। সামনে ম্যাটাডোর যাওয়ার মতো রাস্তা, আর একটা বিশাল আকাশ।রাস্তা দিয়ে একটা সাইকেল ভ্যান এসে থামল। ভ্যানের ওপর দুটো শিশু, একটির বয়স তিন কি চার অপর টি বোধহয় সাত-আট। সোনালী আলোতেও তাদের মুখ বিবর্ন, ততোধিক বিবর্ন তাদের পোষাক। তাদের চোখে স্বপ্ন নেই, নেই শৈশবের প্রানচ্ছল চাঞ্চল্য। বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে, সে সব কবেই চুরমার হয়ে গেছে।ঠ্যালার আরেক সাওয়ারি এক মধ্যবয়স্কা মহিলা। না মধ্যবয়স্কা বলা হয় তো ঠিক নয়, বয়স ৩৫ মতো। গায়ে একটি মলিন শাড়ি, আর সামান্য কিছু গয়না। তার কৃষ্ণবর্নের মুখখানা যেন পাথর কুঁদে বানানো। সেখানে হাসির আভাস টুকুও কোনদিন দেখা গেছে কিনা সন্ধেহ। চালকের পড়নে হলুদ প্যান্ট যা কোনকালে হয়তো সাদা ছিলো। তার দেহ শীর্নকায় হলেও পেশীবহুল। সারামুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। এই চারজন প্রানীছাড়াও দেখা যাচ্ছে একটি সাউন্ড বক্স, মাউথ পিস, মুরির প্যাকেট, আরো নানা হাজিবাজি জিনিশ।গাড়িখানা থামলে সাওয়ারিরা একে একে নামে যন্ত্রের মতো নিজের নিজের কাজ শুরু করলো। একে অপরের সাথে গল্পকরে সময় নষ্ট করার ‘বিলাশিতা’ এদের নেই। মহিলাটি একটা থালা আর দুটো কাঠি নিয়ে পথের মাঝে বসল। শীর্নকায় লোকটি ঝোলা থেকে একটা ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বার কাঠি গুলো খুজতে লাগলো।ছোট্ট শিশুটি ততোক্ষনে রাস্তায় নেমে পড়েছে, আর কৌতূহলী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ধরা যাক তার নাম মুন্না। মুন্নার দাদা একটা ময়লা ছোপ ধরা টুপি মাথায় দিল। টুপির চুড়ার সাথে একটা ঢিল বাঁধা।মহিলা টি (সম্ভবত মুন্নার মা) কাঠি গুলো দিয়ে থালাটা বারি মারতে লাগলো। লোকটিও ঢোলে বোল তুলল। আর মুন্নার দাদা তার মাথাটা অদ্ভুত কায়দায় নাড়তে লাগলো। ফলে টুপির সাথে বাঁধা ঢিল খানা স্যাটালাইটের মতো মাথার চারপাশে বাঁই বাঁই করে পাক খাচ্ছে।এই হেন ড্রামাটিক্যাল শব্দের ধাক্কায় আমার ঘুমবাবাজি পলায়ন করিল। শব্দের উৎস সন্ধানে মেসের বাইরে এসে দেখি, সোনালী আকাশের নীচে সুন্দর সার্কাসের আয়জন।হ্যাঁ, সবার মতো আমার স্থুল দৃষ্টি তে তাইই ধরা পড়লো। একবারো নজরে এলো না তাদের শুকনো বিবর্ন মুখ গুলো।মনে মনে বললাম বাঃ ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য আদর্শ সাবজেক্ট। এফ.বি তে এর নিচে কি কোটেশান দাওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতে রুমে এলাম।বাকি রুম মেট দুটো তখন শুয়ে শুয়ে আড্ডা মারছে। আমি চার্যার থেকে মোবাইলটা খুলতে খুলতে বললাম “কি কুড়ের মতো শুয়ে আছিস? বাইরে চ সার্কাস হচ্ছে সার্কাস...... আর শোন দরজা- জানলা ভালো ভাবে বন্ধ করে যাবি। এরা হয়তো সামনে খেলা দেখাচ্ছে। পিছন থেকে দেখবি সব মাল গাপ করে দিয়েছে!”বাইরে তখন মুন্নার বাবা দুটো এক্স বারে দড়ি খাটাতে ব্যাস্ত আর মুন্না, মুন্নার দাদা একটা শত ছিন্ন শতরঞ্চির ওপর ছোট খাটো যোগব্যায়াম গোছের কিছু দেখাচ্ছে। এখনো সিরিয়াল গুলো শুরু হয় নি। তাই কলোনি বাসি বিকেলের এই ‘মুফৎ এন্টারটেন্ট’ মিস করতে নারাজ। গোল করে বেশ ভিড় জমেছে। আমি একদম সামনে এসে মোবাইল খানা বাগিয়ে ধরি।এর পরে আরো কয়েকটা খেলা দেখানোর পর, মুন্নার দাদা এক্সবার টা ধরে উঠে পড়ল। তাতে টান টান করে টাঙান দড়ি, এর ওপর দিয়ে সে নানা ভাবে হেঁটে যাবে। বক্সে তখন ‘জিনা ইঁহা, মরনা ইঁহা’ গানটা একটা অদ্ভুত পরিবেশ শৃষ্টি করেছে।আমার হাতে তখন ভিডিও রেকর্ডিং চলছে।কিন্তু, একি.....। কিছুতেই খেলার দিকে মন দিতে পারছি না! বার বার চোখ চলে যাচ্ছে ওদের মুখ গুলোর দিকে। একটা যান্ত্রিক হাসি পর্যন্ত সেখানে নেই। অন্যদিকে যারা খেলা দেখছে তাদের মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। একে পৈশাচিক ছাড়া আর কি বলা যায় আমি জানি না। চোখ মুখ গুলো যেন অহংকার দিয়ে গড়া। কিসের এত অহংকার? এরা বড়লোক ঘরে জন্মেছে বলে?এদিকে ছেলেটা যে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে? নিচে পিচরাস্তার হাতছানি! অথচ, কারোর মুখে এতটুকুও আতঙ্ক বা চিন্তার রেখা নেই। সবাই মজা লুটছে।আমার মনে হোল যেন এক দেবশিশু যেন শরু একটা সাঁকো পার হচ্ছে, আর নিচে হাঁ করে বসে আছে নরখাদকের দল। তাদের দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঝরে পরছে বিষাক্ত লালা। তারা রক্ত চাই, চাই নরমাংস।ইতিমধ্যে মুন্নার বাবা একটা থালা পেতে গেছে। সবাই সেখানে একটাকা, দশটাকা করে ফেলছে, ঠিক ডার্স্টবিনে ময়লা ফেলার মতো। আমিও পকেট থেকে দশটাকা বার করে রাখলাম।সাথে সাথে মনের ভিতর কি যেন একটা খোঁচা দিতে লাগলো। মন কে বুঝালাম এর বেশি আমি কিই বা করতে পারি? এখানে বেশি টাকাও নেই যে দুশোটাকা পড়ে আছে, তা বইমেলার জন্য আবশ্যক।আমাদের মেসের বাড়িওয়ালারা এতক্ষন ছাদ থেকে খেলা দেখছিল।‘অ্যাই তনি শোনো। এটা একটু ধরো তো।’আমার হাতে এসে পড়লো একটা প্যাকেট তাতে চারটে বিস্কুট।‘ওদের থালা তে রেখে দাও।’আচ্ছা আমরা বোধহয় কুকুরদের এভাবে খেতেদি, তাই না?আমি থালাতে প্যাকেট টা রাখলাম। আর সেই সাথে খোঁচাটা যেন দ্বিগুন হয়ে গেল। আর থাকতে পারলাম না। রুমের দিকে ছুটলাম। আমার রুমমেট দুটোও পেছন পেছন এলো।‘এই দরজা বন্ধ কর মশা ঢুখবে’‘দাঁড়া আমি যাবো।’‘টাকা বার করছিস? একশো টাকা দিয়ে কি খাবি?.....আরে খাবার তো আছে।’আমি উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। সাথে ওরাও এলো।আকাশ তখন ফিকে হতে লেগেছে। মুন্না দের ভ্যান গোছগাছ করে রেডি। সেই থালাটার ওপর একশোটাকার নোটটা রাখলাম।সেলফে না হয় একটা বই কমি হোল। শুকনো জ্ঞানের থেকে, ওদের একটুকরো হাসি বেশি মূল্যবান নয় কি?আমি অবশ্য ওদের হাসি দেখার জন্য অপেক্ষা করি নি। দৌড়ে ঘরে এসছি। ভয় হয় হাসির বদলে, যদি দীর্ঘশ্বাস জোটে, ১০০ টাকায় এখন কিই বা হয়?অন্যদিকে তখন রুমমেটদের হাসির রোল উঠেছে।‘আজ সারাদিন আমরা তনি কে এন্টারটেন্ট করবো। তনি আমাদেরো দিতে হবে কিন্তু।’‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তোর অ্যাসিসটেন্ট’এরা আমার থেকে অনেক বড়লোক। অনেক বড়ঘরের ছেলে। এখানে এসেছে শুধুমাত্র ফুটানি করতে। এরা চাইলে ৫০০টাকাও অনায়াসে দিতে পারত।আমার গলায় কি একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে বললাম ‘এতে এত হাসির কি আছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না!’তা করতে ওপর থেকে বাড়িওয়ালি নেমে এসেছে‘তনি.........। তুমি ওদের একশো টাকা দিয়েছ? এখানে বাইরে পড়তে এসেছ। আর.......।বাবা রে বাবা, কঠিন ছেলে! ওরা এমন কিছু খেলা দেখাই নি, যে একশো টাকা দিতে হবে। তার থেকে তোমার বন্ধুদের দিতে।আমি হাসি সার্কাসে ১০০টাকায় অনেক ভালো সিট পাওয়া যায়। তোমরা যদি জানতে কেন দিলাম, তাহলে হয় তো পৃথিবী টা আরো সুন্দর হোত।এর পরে ওপর থেকে সবাই একে একে এসে আমাকে একি কথা নানা ভাবে বলে গেলো। যেন আমার ভেতর কিছু গোলমাল আছে! আসল গোলমাল যে তোমাদের মধ্যে, তা কি তোমরা জানো না?একটু পরে মা ফোন করল।‘হ্যালো, খেয়েছিস কিছু?’‘হ্যাঁ, খাবো। শোন না একটা কথা বলবো। বলো কিছু বলবে না।’‘কি শুনি?’‘বলছি যে। ওই খেলা দেখাতে আসে না বেদ্গুলো।’‘হ্যাঁ।’‘আজ.....আমাদের মেসের সামনে এসছিলো খেলা দেখতে। তো আমি না ইয়ে মানে কি মনে হলো..... একশো টাকা দিয়ে ফেলেছি।’‘তোর কাছে আরো ১০০ ছিলো তো। দিলি না কেন?’ইয়েস, এখানেই আমার বাবা-মা। সব্বার থেকে আলাদা। বাবা ভদ্রলোক যে কতো জনের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করেছে, আর কতো ছেলেমেয়ের বইপত্তের জোগাড় দিয়েছে তার কোন লেখাজোখা নেই। আই প্রাউড ফর দেম।_____________________________________________ওই ওপরে ঈশ্বর নাম ধারি কোন বেক্তি আদৌ আছেন কি না জানি না। যদি থেকেও থাকেন, আমার দৃহ বিশ্বাস, হয় তিনি বদ্ধ কালা, নয় কুম্ভকর্নেই সমগোত্রীয়। আমি কাজটা করেছিলাম শুধুমাত্র আমার বিবেক নামক বস্তুটিকে শান্ত করার জন্য। আমার মন যে কত খানি ছোট তার প্রমান, আমার ট্রাঙ্কে থেকে যাওয়া আরো একটা একশো টাকার নোট।বাইরে তখন আরো একটা সন্ধা নামছে। দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা সাইকেল ভ্যান। তারা আসে অন্যদিগন্ত থেকে, আমাদের আনন্দ দিতে। আবার চলে যায়। আর সাথে, ‘পুরস্কার’ হিসাবে পাওয়া চারটে বিস্কুট।

2 comments:

  1. Anthony Firingee19 June 2015 at 07:20

    Bah..bah...Mon bhore gelo, koshto more gelo!

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লিখেছেন

    ReplyDelete