Monday 29 June 2015

প্রবন্ধ : কবি সুকান্ত ও বর্তমান সময় ~ সুরঞ্জন মণ্ডল


সুরঞ্জন মণ্ডলের চোখে কবি সুকান্ত ও বর্তমান সময় :~

.
সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন বাংলা সাহিত্যে মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী একজন কবি। মার্কসবাদ কথার অর্থ হল সাম্যবাদ। মালিক বা বুর্জোয়া শ্রেনীর সাথে শোষিত, নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণীকে একসারিতে বসানোর মতবাদ হল সাম্যবাদ।
.
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ই আগস্ট। তিনি তার সময়কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির প্রভাব স্বচক্ষে দেখেছেন আর হিংসার বিরুদ্ধে তার কলম গর্জে উঠেছে বার বার। প্রতিবাদী অগ্নিপিণ্ডের মত আছড়ে পড়েছে একের পর এক প্রতিবাদী কবিতা। প্রার্থী, হে মহাজীবন, একটি মোরগের কাহিনী, দুরাশার মৃত্যু, ছাড়পত্র প্রভিতি লেখনিতে তার ছাপ আমরা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাই।
.
বুর্জোয়া শ্রেণী তখন যেমন ছিল এখনও তেমন ভাবেই বিদ্যমান। রাজনৈতিক দলের মতো তাদেরও রঙ বদলেছে মাত্র। আজ ২০১৫ সালে পঁচে যাওয়া এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা কি তার গন্ধ পাইনা? নাকি প্রতিবাদের ভাষা আমরা একটু একটু করে ভুলতে বসেছি? নাকি আধুনিকতার ঠেলায় বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ির আড়ালে জঞ্জালের স্তুপের মত অন্ধকার বস্তি গুলোকে আর নজরে পরে না? কবি সুকান্ত হয়ত গন্ধটা পেয়েছিলেন। আর ক্রমশ ঘনিভুত হতে থাকা অন্ধকার তার নজরে পড়েছিল। সেই জন্যই হয়ত একফালি আলোর খোঁজ করছিলেন। নইলে কেন বলবেন-
.
হে সুর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও,
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
.
হে সূর্য
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড,
তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে
পরিণত হব!
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,
তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।।
.
আমরা ক্রমশ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাচ্ছি। অথবা স্বার্থান্বেষী হয়ে নিজের স্বপ্ন নিয়ে এতটাই মজগুল হয়ে পড়েছি যে ভুলে যাচ্ছি ছেড়া কাঁথায় শুয়েও স্বপ্ন দেখা যায়। সুকান্ত কিন্তু অন্য স্বপ্ন দেখতেন। শোষণ বিহীন এক নতুন বিশ্বের স্বপ্ন। এক প্রতিবাদী জনতার বিশ্ব। যেখানে একটা শিশু জন্ম মুহুর্ত থেকে প্রতিবাদ জানাবে-
.
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা তেতাল্লিশের মম্বন্তরের রেশ এখন আর নেই। এখন যা রেয়েছে তা চোখে দেখা যায় না। আমার বোনের ছিড়ে খাওয়া লাশ যেদিন এঁদো গলিতে পড়ে থাকবে সেদিন সমস্যা নজরে পড়বে। নইলে প্রতিদিন সকালে গরম চায়ের সাথে দৈনিক সংবাদ পত্রের পাতা উল্টাব আর খুন, ধর্ষণ আর শাসক দলের বেফাঁস মন্তব্য আয়েশ করে গিলব।
.
আজকের দিনে প্রতিবাদ করতে সেখাটা ভীষণ ভাবে দরকার। দরকার একজন কবি সুকান্তের। দরকার একটা গর্জে উঠা প্রতিবাদী কলমের। আর কবিতার স্নিগ্ধতা নয়, চাই কঠিন কঠোর গদ্য।
.
আমি রাজনীতি বুঝিনা, বুঝতে চাইও না। তবে যখন এক থালা ভাতের জন্য আমার পেট খিদেতে চোঁচোঁ করে, তখন তার যন্ত্রণা ভীষণ ভাবে অনুভব করি। ওই অট্টালিকা নয়, এক থালা ভাত আর একটু সম্মানের সন্ধান করি প্রতিনিয়ত। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দুর্গাপুজোর ধুমধাম করে ভোট হয়। আমরা সেজেগুজে ভোট দিতে যাই। শাসক দলের রঙ বদলায়। কিন্তু আমি আমার সম্মানের সন্ধান পাইনা। “গরীবের সম্মান” কথাটিই এখন সোনার পাথরবাটি।
.
আমার সম্পদ বলতে ভাঙাচোরা এই শরীর। আর গায়ের রং? লাল নয়, গেরুয়া নয়, সবুজও নয়; সেরফ রোদে পুড়ে কালো। কালো রঙের কোন ব্র্যান্ড ভ্যালু নেই। তাই আমার গুরুত্ব কেউ দেয় না। তবুও আমি কালোকেই ভালোবাসি।
.
আমার পেটে এখন এক শতাব্দীর খিদে। পুর্নিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি ছাড়া কিছু নয়। না, আমি রঙ বদলাতে রাজি নই। কেউকি আমায় একটুকরো রুটি এনে দিতে পারো?

No comments:

Post a Comment