Wednesday 24 June 2015

পুস্তক পর্যালোচনা- প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায়



নাম : বিষকন্যা
ধরন : কাল্পনিক উপন্যাস
রচনা : দেবতোষ দাশ
প্রকাশনা : পত্র ভারতী
দাম : ১৫০ টাকা

আনন্দময় জীবন
~~~~~~~~~~~~~
জলের প্রতিভা।
.
প্রথমে উপন্যাসটির এই নামই রেখেছিলেন লেখক দেবতোষ দাশ। নামটি চয়ন করেছিলেন জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা (‘তোমাকে’) থেকে। পরে ‘বাণিজ্যিক স্বার্থে’ নামটির পরিবর্তন ঘটান প্রকাশনার কর্ণধার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। ফেসবুকের একটি গ্রুপকে দেওয়া ছোট সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন লেখক স্বয়ং।
.
নামের স্বার্থকতার চেয়েও বড় প্রশ্ন লেখকের এই প্রথম উপন্যাস কতটা স্বার্থক। পাঠের পরেই উপলব্ধি হবে যে পরম নিশ্চিন্তে নতুন উপন্যাসে হাত দিতে পারেন তিনি।
.
কবিতাময় এ উপন্যাস। বেশিরভাগটাই জীবনানন্দ। পাঠের সম্পূর্ণ আনন্দ তাই জীবনানন্দ অনুরাগীদেরই প্রাপ্য। তবে লেখকের প্রতিভায় বাকিরাও কিছুমাত্র বঞ্চিত হবেন না।
.
প্রথম পরিচ্ছেদে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ অরিন্দম কর্মসূত্রে দীঘা বেড়াতে এসে বাসেই আলাপ সেরে ফেলেছে শ্রুতকীর্তির সঙ্গে। দ্বিতীয়তে পরের দিন খেলাচ্ছলে সমুদ্রে নেমে ঘটল অরিন্দমের মৃত্যু। এ কি দুর্ঘটনা, না কি হত্যা, না দুইই? যদি হত্যা হয়, তবে কে করল?
.
উত্তরের জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করার দরকার নেই শেষ পৃষ্ঠা অবধি। সঙ্গে-সঙ্গেই জবাব মিলেছে।
.
তবে বাকি আটত্রিশটি পরিচ্ছেদে কী রয়েছে? রয়েছে থামতে না চাওয়া পাতা ওলটানো আঙুল, রয়েছেন পরতে পরতে জীবনানন্দ আর কিছুটা শেকসপিয়ার, রয়েছে পাগল করা মধুজা সেন, রয়েছে রহস্যসন্ধানী ডিকে, হিংসা, প্রেম, কামনা, যৌনতা, আরও মৃত্যু, আরও কবিতাসহ জমাটি এক থ্রিলার।
.
হয়তো একটু বাড়িয়েই বলা হয়ে গেল। তাহলে কমগুলো এবার বলা যাক। কাহিনি অনেকটা চেনা পথে এগিয়ে জানা গন্তব্যেই শেষ হয়েছে। দুরন্ত কোনও চমক দিতে ব্যর্থই হয়েছেন লেখক। অপরাধীকে সামনে পেয়েও ঠকে যাবার, শিকার ফসকে যাবার যন্ত্রণা ও ধরা পড়ে যাবার উৎকণ্ঠা পাঠককে দিতে কোনোই চেষ্টা নেই। পৃষ্ঠাগুলো চোখ বড় বড় করে গোগ্রাসে গিলতে থাকলে ঠিক আছে, কিন্তু চোখ ছোট করে ফেললেই মুশকিল; তখনই ধরা পড়ে যাবে অপরাধের ধরন, কারণ, পারিপার্শ্বিকতা, যুক্তি, মোটিভ ও সম্ভাব্যতা বিষয়ে যাবতীয় অসঙ্গতি। কয়েক জায়গায় ‘পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে যে’ গোছের যে আদি বঙ্কিমী ধাঁচ অবলম্বন করে কাহিনির আধুনিকতায় হাস্যকর প্রলেপ দিয়ে ফেলেছেন। মধুজা সেনের শরীরে একটু বেশিই ঘুরেছেন এবং সম্পূর্ণ অকারণে মধুজা বাড়ি ঢুকে তার অন্তর্বাসদুটি কীভাবে খুলে ফেলছে অন্তত দু’বার তার বর্ণনা দিতে ভোলেননি। লেখক ইতিপূর্বে ছোটগল্পের মোড়কে লেখা প্রবন্ধগুলিতে তাঁর সুগভীর সাহিত্যজ্ঞানের যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে তাঁর পত্রভারতীয় অনীশ-রঞ্জন গোত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে বলে তো মনে হয় না।
.
তবে দেবতোষ দাশের লেখনীকে ওসব মানদণ্ডে বিচার করা যায় না। যে নিপুণতায় তিনি কবিতার চাদরে একটি উপন্যাসকে সক্ষমভাবে জড়িয়েছেন, যেভাবে সংলাপ রচনা করেছেন, প্রাণপুরুষের সঙ্গে নিজের মনে মধুজার হাহাকার যেভাবে ব্যক্ত করেছেন, যেভাবে একটি সামান্য রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসকে কাব্যময়তার সুগভীরে নিয়ে গিয়ে যে অলীক আনন্দ দান করেছেন, কবিতাকে পাঠকের আরও কাছের ও নিজের করে তুলেছেন তার জন্য সাত ভুল মাফ হতেই পারে। উপরি পাওনা হিসেবে যেভাবে মহিলাদের বিচিত্র সব সাজপোশাকের উল্লেখ তিনি করে গিয়েছেন একের পর এক তাতে কোনও মহিলারও নিজের ফ্যাশনধারণা সম্পর্কে লজ্জিত হওয়া আশ্চর্যের নয়।
.
উপন্যাসটি হয়তো একবার, কিন্তু বহু শব্দ বার বার পড়ার মতো। তাই হয়তো একটি পেনসিল নিয়ে পড়তে বসাই বিচক্ষণতার পরিচায়ক।
.
পত্র ভারতীর চেনা ঝকঝকে পরিবেশনা প্রশংসাপ্রাপক। দেবযানী ঘোষালের প্রচ্ছদ ও অলংকরণও যথাযোগ্য।
.
প্রথম উপন্যাসের জন্য নবীন সাহিত্যিক দেবতোষ দাশকে আন্তরিক অভিনন্দন। সার্থক হোক আপনার কলমের প্রতিভা।
.
____________________

No comments:

Post a Comment